গ্ৰামটির নাম পারিলা। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার তপন ব্লকের আউটিনা অঞ্চলের (বিধানসভা– গঙ্গারামপুর) অন্তর্গত একটি গ্ৰাম। বালুরঘাট সদর থেকে দূরত্ব প্রায় ছাব্বিশ কিলোমিটার। গঙ্গারামপুর সদর থেকে দূরত্ব প্রায় চব্বিশ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সীমানা লাগোয়া অর্থনৈতিক ভাবে অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া একটি গ্ৰাম। অথচ এই গ্ৰামের একটা গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। শুধু জেলা বা রাজ্য বলে নয়, গোটা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এক স্মরণীয় অতীত, এক গৌরবময় ইতিহাস।

ছবিতে দেখবেন বি এস এফ ক্যাম্প এবং পারিলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিকটেই কর্দমাক্ত মাটিতে একটি স্মৃতিফলক। ফলকটির লেখা এতটাই বিবর্ণ যে একদম কাছ থেকেও পরিষ্কারভাবে পড়া নিতান্তই কঠিন। অথচ এটাই কি হওয়া উচিত ছিল ?
এই স্মৃতিফলকটিতে চারজনের নাম আছে। মল্লিকপুর গ্ৰামের এতোরা উড়াও। মালঞ্চা গ্ৰামের চৈতু বর্মণ। মহলাকুড়ি গ্ৰামের অধর বর্মণ। হাট সাওয়ালি গ্ৰামের কেকারা বর্মণ। বর্তমানে শেষের দুটি গ্ৰাম বাংলাদেশের অন্তর্গত। এই চারজন প্রাণ দিয়েছিলেন, শহীদ হয়েছিলেন ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে। ১৯৪২ সালের ১৮ ই সেপ্টেম্বর। একবার ভাবুন! ১৯৪২ সালের “ইংরেজ, ভারত ছাড়ো” আন্দোলনে দেশের বহু এলাকা তখন উত্তাল। আগস্টে শুরু হয়ে আন্দোলন তীব্র আকার নেওয়া শুরু করেছিলো সেপ্টেম্বর থেকে। মাতঙ্গিনী হাজরাদের উপর মেদিনীপুরে ইংরেজ পুলিশের গুলিবর্ষণ হয়েছে ১৯৪২ সালের ২৭ শে সেপ্টেম্বর। আসামের ঢেকিয়াজুলি থানা দখল করতে যাওয়া কনকলতা বরুয়াদের উপর বৃটিশ পুলিশের বুলেট বৃষ্টি হয়েছে ১৯৪২ সালের ২০ শে সেপ্টেম্বর। অথচ তৎকালীন অবিভক্ত দিনাজপুরের (বর্তমান দক্ষিণ দিনাজপুর) এই “পারিলা” এলাকার ইংরেজ পুলিশের সাথে বিপ্লবীদের মুখোমুখি মরণপণ লড়াইয়ের এই ঘটনাটি তারও আগের। অথচ ওই দুটি বিপ্লব ইতিহাসের বহু আলোচিত, বহু চর্চিত ইতিহাসের পাশাপাশি এই দিনাজপুরের গৌরবময় সংগ্ৰামের ইতিহাসটি সামান্যতম স্থানও অধিকার করতে পারেনি। সম্পূর্ণ বিস্মৃত ইতিহাস। এতোরা ওঁরাও, চৈতু বর্মণ, অধর বর্মণ, কেকারা বর্মণদের নাম কতজন জানেন ? ভারতবর্ষ ছেড়ে দিন, পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে দিন, দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাও ছেড়ে দিন। তপন ব্লকের এমনকি আউটিনা অঞ্চলের ক’জন মানুষ এই চার মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদের নামের সঙ্গে পরিচিত? আমি পারিলা গ্ৰামেরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম যে সেই গ্ৰামেরও অনেকেই চারজনের নাম বলতে পারছেন না। এই গৌরবময় ইতিহাস কেন সকলকে জানানো হয় নি? এই লজ্জা কাদের ? এই পরাজয় কাদের? এই বিস্মৃতির জন্য দায়ী কারা ?
১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ ই সেপ্টেম্বর বালুরঘাট ব্লকের ডাঙ্গি থেকে লং মার্চ করে এসে প্রখ্যাত বিপ্লবী সরোজ রঞ্জন চ্যাটার্জীর নেতৃত্বে বিপ্লবীরা বালুরঘাট শহরের দখল নিয়ে নিয়েছিলো। ট্রেজারি বিল্ডিং থেকে ইউনিয়ন জ্যাক টেনে নামিয়ে দিয়েছিলো। সরকারী দপ্তরগুলির দখল নিয়ে নিয়েছিলো। কয়েকদিন পর্যন্ত বালুরঘাটে ইংরেজ শাসনের অস্তিত্ব ছিলো না। ওই ১৪ ই সেপ্টেম্বরের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিলো পাশাপাশি থানাগুলিতেও। তারই সূত্র ধরে ১৮ ই সেপ্টেম্বর ‘পারিলা’র ওই রোমহর্ষক বিপ্লবী- পুলিশ সংঘর্ষ। ছবিতে দুটো তেঁতুল গাছ দেখবেন। ওই তেঁতুল গাছগুলির পিছনে তীরধনুক নিয়ে গ্ৰামবাসীরা অবস্থান করছিলো। সামনের একটি স্কুলে (জানিনা ছবিতে যে পারিলা বিদ্যালয়টিকে দেখছেন ওখানেই অন্য নামে কোন বিদ্যালয় ছিলো, নাকি আরেকটু পাশাপাশি কোথাও ছিলো) লোডেড রাইফেল সহ পজিশন নিয়েছিলো ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ।বন্দুকের বিরুদ্ধে তীরধনুক। অনেকটাই অসম লড়াই ছিলো। কিন্তু এতোরা উড়াও, কেকারা বর্মণ(তার বয়স তখন সবে ১৮) রা কেউ পালিয়ে যায় নি। তীর ধনুক নিয়েই লড়াই চালিয়েছিলো আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে। বিপ্লবীদের চারজন নিহত, সতেরোজন আহত। তারপরেও তাদের মরণপণ মানসিকতা দেখে একটা সময় নিজেদের জীবন বাঁচাতে স্কুলের পিছনের দরজা দিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়েছিলো ইংরেজ সরকারের পুলিশ।

আমি গ্ৰামবাসীদের অনেকের বাড়ীতে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছি। কিন্তু সঠিক তথ্য পাচ্ছিলাম না। অবশেষে একদম সীমানার ধারে কাঁটাতারের বেড়ার পাশে গিয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বলতে বলতে সন্ধান পেলাম স্বপণ হেমব্রমের (ছবিতে দেখবেন সাইকেলের ক্যারিয়ারে পাট বোঝাই করে আনছে)। তার দাদু ভগত হেমব্রম ছিলেন ওই ১৯৪২ এর ১৪ ই সেপ্টেম্বর সরোজ রঞ্জন চ্যাটার্জীর নেতৃত্বে ডাঙ্গি থেকে বালুরঘাট ট্রেজারি অভিযানে অংশগ্ৰহণ করা অন্যতম সদস্য। তার দাদুর কাছ থেকে ঘটনাবলীর বিবরণ শুনেছেন তার বাবা মঙ্গল হেমব্রম। তার বাবার মুখ থেকে শোনা এই সংক্রান্ত বহু ঘটনা স্বপন আমাদের জানালো। জিজ্ঞাসা করে জানলাম সে এম এ পাশ করেছে। চাকরী পায় নি বলে কৃষিকাজেই মন দিয়েছে। একদম কাঁটাতারের বাম পাশের জমিগুলি বাংলাদেশের মধ্যে পড়ে। জমিগুলি ভারতীয়দের। বাংলাদেশের ভূখন্ডে থাকা ভারতীয় জমি। কথাপ্রসঙ্গে স্বপন জানালো যে কয়েকদিনের মধ্যে ওর বাবা মঙ্গল হেমব্রমের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবে। দুঃখপ্রকাশ করছিল যে এই বিষয়টি নিয়ে কোন স্তরেই কোন আলোচনা হয় না। একমাত্র “প্রত্যুষ” নামের একটি সংস্থা ওই দিন ওখানে এসে ওই ঘটনাকে স্মরণ করে কিছু অনুষ্ঠান করে। এছাড়া আর কেউ কখনো এই বিষয় নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্ৰহ দেখায় নি। স্মৃতিফলকটির চারধারে একটা বেড়া পর্যন্ত নেই। এই অবহেলা, বিস্মৃতি অত্যন্ত দুঃখজনক, লজ্জাজনক, বেদনাদায়ক। আমরা বিস্মৃতির অতল থেকে এই গৌরবময় ইতিহাসকে সর্বসমক্ষে আনবো। এটা করতে হিন্দু সংহতি বদ্ধপরিকর।