
“Je suis Samuel.” “Je suis Samuel.” এই স্লোগানেই এখন মুখরিত ফ্রান্সের আকাশ বাতাস। আট থেকে আশি প্রত্যেকেই রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের ভাষায় এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করছে , বিপ্লব কট্টরবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে। ফ্রান্স এর জনগণ যেন মৌলবাদের বিরুদ্ধে যে কোনো মূল্যে এই যুদ্ধ জিততে চাইছে, সূচনা হতে চলেছে এক নবজাগরণের।
রাষ্ট্রের যে কোনো বিপ্লবের একটি সূচনা থাকে, যে সূচনার প্রেক্ষাপট তৈরী হয় তার দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ ও রাগ কে সঞ্চয় করে। তাহলে ফ্রান্সের এই ক্ষোভ ও রাগের উৎস কোথায় ?
যদিও এর শুরু হাজার বছর আগে তবে ফ্রান্সের এই ঘটনা সাম্প্রতিক ঘটনা , সাড়ে পাঁচ বছর আগের সেই রক্তাক্ত দিনটি ফ্রান্সবাসী আজও ভুলতে পারেনি। ২০১৫ সালে ৭ জানুয়ারি ইসলাম ধর্মগুরুর কার্টুন ছাপানোয় ‘শার্লি এবদো’ পত্রিকার দফতরে হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন আল-কায়দা। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান পত্রিকার ১২ জন শিল্পী ও কর্মী। তার তিন দিনের মধ্যে ফের হামলা চালিয়ে আরও পাঁচ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। পুলিশের পাল্টা গুলিতে মারা যায় তিন হামলাকারীও।
সেই শুরু। এর পর গত কয়েক বছরে জঙ্গি হামলায় ফ্রান্সে অন্তত আড়াইশো জন নিহত হয়েছেন। সম্প্রতি ‘শার্লি এবদো’ মামলায় জঙ্গিদের সাহায্য করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয় কয়েক জন। এই বিচারকে সম্মান জানিয়ে ২০১৫ সালের বিতর্কিত ব্যঙ্গ চিত্রটি পুনরায় ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেয় পত্রিকাটি। শার্লি এবদো-র বর্তমান ডিরেক্টর লরাঁ সুরিসো স্পষ্ট ভাষায় বলছেন , ‘আমরা মাথা নোয়াবো না। আমরা হাল ছাড়ব না।’ সঙ্গে প্রথম পাতার শিরোনাম, ‘অল অফ দিস, জাস্ট ফর দ্যাট।’
এরপর কয়েকদিন আগে ১৬ই অক্টোবর শুক্রবার দুপুরে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ‘আল্লাহু আকবর’ রব তুলে প্রকাশ্য রাস্তায় এক শিক্ষকের মাথা কাটে এক যুবক। জানা গেছে প্যারিসের একটি স্কুলে পড়াতেন স্যামুয়েল প্যাটি নামের নিহত ওই শিক্ষক। ছাত্রদের ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষা দিতে গিয়ে হজরত মহম্মদের একটি কার্টুন চিত্র দেখিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকেই বিপত্তি শুরু। ওই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েই স্যামুয়েলের উপর সশস্ত্র হামলা চালায় ওই চেচেন মৌলবাদী। ঘটনার পর ফ্রান্সের নিরাপত্তারক্ষীরা সেই জেহাদিকে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনাকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ সন্ত্রাসবাদী হামলা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে এক নাবালক সহ চারজনকে ইতিমধ্যে আটক করা হয়েছে।
এর পর থেকেই ক্ষোভে ফেটে পরে ফ্রান্সবাসী , প্রতিবাদের দারা জন্ম হয় এই বিপ্লবের। গান,কবিতা,স্লোগানের মাধ্যমে চলতে থাকে প্রতিবাদ। ফ্রান্সের শহর মন্টপিলিয়ার ও টাউলুসে শুরু হয়েছে এক অভিনব প্রতিবাদ প্রয়াত শিক্ষক কে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়ার জন্য বড় বড় হোটেলের দেওয়ালে শার্লে এবদোর বানানো মহম্মদের বিতর্কিত কাৰ্টুন চিত্র গুলিকে প্রদর্শন করা হচ্ছে ,যে কার্টুনের জন্য প্রাণ যায় এত মানুষের।
ফ্রান্সের ওসিটনেই এলাকার সভাপতি ক্যারোল ডেলগা বুধবার ট্যুইটারে কার্টুন দেখানোর ঘোষণা করেন। উনি বলেন, শিক্ষক স্যামুয়েলকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়ার জন্য পয়গম্বর মোহম্মদের বিতর্কিত কার্টুন দেখানো হবে। ডেলগা এই ঘটনার প্রতিবাদে পয়গম্বর মোহম্মদের কার্টুন দেখানোর সমর্থন করেন। উনি বলেন, এটি একটি কঠোর পদক্ষেপ হবে, যেটি আমাদের দেশের মূল্যকে বোঝাতে সাহাজ্য করবে। ডেলগা বলেন, ‘এই প্রতীকী পদক্ষেপটি ছাড়াও আমি আমার সহকর্মীদের কাছে একটি বার্তা পাঠাতে চাই যে ধর্মনিরপেক্ষতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং বিবেকের স্বাধীনতা নিয়ে কোনও আপস করা হবে না। এটিই আমাদের প্রজাতন্ত্রের মডেলের ভীত।”ডেলগা বলেন, গণতন্ত্রের শত্রুদের সামনে মাথা নোয়াব না। যারা ধর্মকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে তাদের সামনে আমরা দুর্বল হব না। এই প্রজাতন্ত্রকে নষ্ট করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে এমন লোকের সামনে রুখে দাঁড়াতে হবে।
একই মত ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর , বুধবার প্যারিসের সরবনে ইউনিভার্সিটিতে নিহত শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটিকে সম্মান জানাতে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ম্যাক্রোঁ বলেন, “তাকে (স্যামুয়েল প্যাটি) হত্যা করা হয়েছে কারণ ইসলামপন্থী উগ্রবাদীরা আমাদের ভবিষ্যত কেড়ে নিতে চায়। আমরা তা হতে দেবো না।” “ফ্রান্স কার্টুন প্রদর্শন বন্ধ রাখবে না। ” এরপর ফ্রান্সের সরকারি ভবনেও মহম্মদের কার্টুন এর চিত্র দেখানো শুরু হয়।
ইতিহাসের পাতা থেকে এরকমই একটি ঘটনা কলকাতার বুকেও দেখা যায়।কোলকাতার বিখ্যাত বইয়ের দোকান ‘সেন ব্রাদার্স’-এর মালিক ভোলানাথ সেনকে তার দুইজন কর্মচারী সমেত ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে দুইজন মুসলিম যুবক নৃশংসভাব খুন করে। ‘প্রাচীন কাহিনী’ নামে তৃতীয় ও চর্তুথ শ্রেণীর পাঠ্য হিসেবে একটি বই ভোলানাথ তার প্রকাশনি থেকে প্রকাশ করেছিলেন। বইটির লেখক স্বয়ং ভোলানাথ সেন। এটি সরকার পাঠ্য পুস্তক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেই বইতে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদের নামে যে চ্যাপ্টার ছিল সেখানে ভাল ভাল কথা বলে তাকে সম্মান করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে একটা ছবি ছাপা হয়েছিল যেখানে মসজিদে মুহাম্মদ দাঁড়িয়ে আছেন আর তার সামনে জিব্রাইল উপস্থিত। এই ছবিটি বৃটিশ মিউজিয়াম থেকে অনুমতি নিয়ে বইতে প্রকাশ করা হয়েছিল। অর্থ্যাৎ, এই ছবিটি বৃটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। কিন্তু ঢাকার একজন মুসলমান জমিদারের ধর্মানুভূতিতে প্রচন্ড আঘাত লাগে এই ছবি দেখে। সে কোলকাতায় এসে দুজন পাঞ্জাবী মুসলমান যু্বককে উদ্বুদ্ধ করে এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। জমিদারের কথামত দুই যুবক ভোলানাথকে খুন করে যায় তার দুই কর্মচারী সমেত। বিপ্লবী নগেন্দ্রনাথ দত্ত এই সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছিলেন, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আমরা যখন স্বদেশী করে আলীপুর জেলে ছিলাম তখন ঐ যুবক দুটিও এই জেলে ছিল। দেখতাম তাদের দেখতে মুসলমান নারী-পুরুষ এসে ভীড় করত। তারা তাদের ভক্তিশ্রদ্ধা জানিযে যেতো। পরে মুসলিম সমাজের কাছে তারা শহীদের মর্যাদা পেয়েছিল। ইসলামের নবীকে নিয়ে সুখ্যাতি করেও খুন হতে হযেছিল লেখক ও প্রকাশক ভোলানাথ সেনকে।
ফ্রান্সবাসীর এই লড়াই তারা জিততে পারবে কিনা তা ভবিষ্যৎ বলবে ,কিন্তু বিগত ১৪০০ বৎসর ধরে এক ধর্মের যে কট্টরবাদ তত্ত্ব যা কেড়ে নিয়েছে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ, যে কট্টরবাদ ইতিহাসের পাতায় লিখে দিয়েছে শত শত নিষ্ঠুর ক্রুসেড এর কাহিনী। যে কট্টরবাদের জন্য বাংলাদেশ থেকে সিরিয়া , আফ্রিকা থেকে আমেরিকা , ফ্রান্স থেকে পাকিস্তান সর্বত্র নিজের দেশ ,ঘর -বাড়ি ছাড়তে হয়েছে কোটি কোটি মানুষকে। সেই কট্টর মৌলবাদ এর শেষ কোথায় ? তবে কি ‘শেষের শুরু’ শুরু হলো ফ্রান্স থেকে , কট্টরবাদ,মৌলবাদের অন্ধকার কাটিয়ে কি নবজাগরণের সূর্য উঠছে ? যে ভোরে থাকবে ভালোবাসা ,মানবতা , বিশ্ব প্রেম।
