ভাতৃদ্বিতীয়া
সঞ্জয় সোম
স্বদেশীয় পরিচয়ের জন্য গর্ববোধ হয়, এমন প্রত্যেকটি মানুষই জাতীয়তাবাদী, কেউ কেউ সেটি খোলাখুলি স্বীকার করেন, কেউ করেন না। তবে যাঁদের বহিঃপ্রকাশ নেই তাঁরা অন্যদের চেয়ে কিছু কম জাতীয়তাবাদী, এটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং উল্টোটাও হতে পারে। সাহেবদের দেশে থাকার সময় বহু যুগলকে দেখেছি রাস্তায়-ঘাটে দিবারাত্র একে অপরের গাত্রলগ্ন আর বছর না ঘুরতেই ছাড়াছাড়ি। ওদিকে আমাদের দেশে বিয়ের ত্রিশ-চল্লিশ বছর হয়ে গেছে অথচ জনসমক্ষে কোনোদিন একে অপরের হাত পর্য্যন্ত ধরেননি, এমন স্বামী-স্ত্রী আকছার দেখা যায়, যে দেশের যা সংস্কৃতি।
প্রদর্শিত জাতীয়তাবাদের একটা বড় সমস্যা হলো যে সেটি অনেকক্ষেত্রেই তাৎক্ষণিক বা উগ্র ও বহুলাংশে স্বার্থকেন্দ্রিক এবং বহুক্ষেত্রেই সেটি প্রকৃত জাতীয়তাবোধে উন্নত হয়না। অথচ জাতীয়তাবোধ ছাড়া কিন্তু দেশের একতা ও অখণ্ডতার জন্য প্রাণপাত করার প্রেরণা পাওয়া অসম্ভব। জাতীয়তাবাদ থেকে জাতিয়তাবোধে উত্তিরণের পথ সহজ নয়, তার জন্য বৌদ্ধিক এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অনুশীলন প্রয়োজন। অবশ্যই কোনো একজন বোধি এবং ব্রতীই একজন সাধারণ নাগরিকের মধ্যে সেই বোধের সঞ্চার করেন এবং তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেন। সেই হিসেবে দেখতে গেলে এ এক গুরমুখী বিদ্যাও বটে। তবে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নৈতিক অধঃপতনের সাথে তাল মিলিয়ে এমন ব্রতীর সংখ্যাও দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, এ এক মারাত্মক আশঙ্কার কথা।
মূল বিষয়টি হলো, ব্যক্তিগতস্তরে আমি যেমন একজন একক, তেমনি আমার পরিবার সমাজের মধ্যে একটি একক, আমার সমাজ আমার দেশের মধ্যে একটি একক, আমার দেশ এই বিশ্বের মধ্যে একটি একক এবং এই বিশ্ব গোটা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে একটি একক। প্রত্যেকটি এককের যেমন নিজস্বতা আছে তেমনিই আবার সমস্ত একক যদি সমষ্টি হয়ে একত্রিত না হতে পারে তাহলে এই বিভিন্নতার মিলিত সুফল বৃহত্তর ক্ষেত্রে সবাই মিলে ভোগ করা অসম্ভব। জাতীয়তাবাদ আমাদের একটি রাষ্ট্রীয় একক হিসেবে পরিচয় দেয় বটে কিন্তু একমাত্র জাতীয়তাবোধ রাষ্ট্রজীবনে আমাদের ভাগিদারী অর্থপূর্ণ করে তোলে। জাতীয়তাবোধ জাগলে সত্যি সত্যিই আমরা আমাদের বিবিধতাকে উদযাপন করতে সক্ষম হই, আমাদের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা গড়ে ওঠে, প্রত্যেকটি এককের শক্তিকে একত্রিত করে জাতি হিসেবে আমরা বিকশিত হই।
বহুযুগ ধরে এই পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস থেকে এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে ওঠে যা ধীরে ধীরে আমাদের জাতীয় স্বত্তার পরিচায়ক এবং নির্ণায়ক শক্তিতে পর্যবসিত হয়। এই সম্মিলিত সংস্কৃতি ভাষা, পন্থ, খাদ্যাভ্যাস, প্রাকৃতিক পরিবেশ, বর্ন, আচার ইত্যাদি সমস্ত ভেদের উর্দ্ধে। বহু যুগ ধরে বিভিন্ন সামাজিক একক পুঞ্জীভূত হতে হতে একটি জাতীয় এককের জন্ম হয়, যার নাম রাষ্ট্র। তার একটি নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে ওঠে যা ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক সংস্কৃতির উর্দ্ধে, যাকে ইংরিজিতে বলে composite culture। এই রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির প্রতি পূর্ন আস্থা রাখার আর এক নামই হলো জাতীয়তাবোধ। জাতীয়তাবাদ বাহ্যিক, বোধ বৌদ্ধিক, অভ্যন্তরীন।
এই দেশ আমার মা, আমরা সমস্ত দেশবাসী তাঁর সন্তান এবং স্বাভাবিকরূপেই মায়ের পরিবারের অংশ হিসেবে সমস্ত দেশীয় ভাই-বোনের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহায়, ভালোবাসা, সহমর্মিতা এবং সহযোগিতা থাকবে, এর মধ্যে কোনো প্রশ্নচিহ্নের স্থান নেই, শক্তি প্রদর্শনেরও স্থান নেই। তার মানে কি জাতীয় জীবনে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। কোনো অশুভ শক্তি যদি আমাদের এই মূল জাতীয় সংস্কৃতির পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে, তাকে নষ্ট করার চেষ্টা করে, জোর করে তাদের অসভ্য মুল্যবোধ জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, সম্মিলিতভাবে তাকে প্রতিহত করার প্রয়োজন আছে বৈকি, প্রয়োজনে প্রতিশোধও নিতে হবে যাতে দ্বিতীয়বার এমন দুষ্কর্ম করার সাহস কেউ না পায়। কেউ আমাদের ঘর ভাঙতে আসলে আমরা রুখে দাঁড়াব না, প্রয়োজনে প্রতিআক্রমণ করবো না, তাই কখনো হয় নাকি?
রাষ্ট্রশক্তির প্রয়োগ আসলে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন। রাষ্ট্রশক্তি মানে কেবল সরকারি শাসনতন্ত্র নয়, রাষ্ট্রশক্তি মানে রাষ্ট্রের প্রত্যেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। স্বভাবতই জাতির অস্তিত্বরক্ষার এই লড়াই যে সৈনিকরা লড়বেন, তাঁরা নিবেদিতপ্রাণ হবেন, জাতীয়তাবাদী হবেন। এই লড়াই আসলে জাতীয়তাবোধ রক্ষার লড়াই। কিন্তু ভাবার বিষয় এই, যে আজ ভাতৃদ্বিতীয়ার দিন যখন বাঙালির ঘরে ঘরে ভাই আর বোন তাঁদের পবিত্র পারিবারিক বন্ধনকে ভাইফোঁটার আসনে আরো সুদৃঢ় করছেন, তখন কেউ কেউ জাতীয়স্তরে দেশীয় ভাই-বোনদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে প্রোথিত আত্মিক বন্ধনকে ভেঙে দেওয়ায় প্রচেষ্ট। তাহলে কি যে শৈব, বৈষ্ণব ও শাক্তভূমিতে বন্দেমাতরম মন্ত্র উদ্গত, জাতীয়তাবোধের উৎপত্তিস্থল সেই বাংলায় আজ আমরা শুধুমাত্র পারিবারিক স্তরে ‘যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা’ বলেই দায় সারবো?