প্রীতম চট্টোপাধ্যায়
৯ই সেপ্টেম্বর, ১৯১৫। তখনো ভোর হয়নি। ত্রিশ কোটী ভারতবাসী,কাবুল থেকে রেঙ্গুন, শ্রীনগর থেকে কন্যাকুমারী, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পাঁচজন বঙ্গসন্তানকে ঘিরে প্রায় পাচ শতাধিক নেকড়ে, কিন্তু এগোতে ভয় পাচ্ছে। ওদিকে ঝিনাইদহে, দিদি বিনোদ বালা,স্ত্রী ইন্দুবালা,নিদ্রাহীন রাত কাটিয়ে অভ্যস্ত। দিদির এক কথা – যেন শুনতে না হয়, সিংহ পিঞ্জরাবদ্ধ। তিন শিশুপুত্র আশালতা, তেজেন্দ্র নাথ, বীরেন্দ্র নাথ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বিনোদবালা কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে দিলে, ইন্দুবালা জেরা করেননা মনে পড়ে যায়, স্বামীর পত্রাংশ” ক্ষনিকের দুর্বলতা সকলেরই আসতে পারে, সে সময় ধৈর্য্য সহকারে দিদিকে সাহায্য করিও”। বহু জন্ম তপস্যা করলে, বাঙালীর ঘরে এত পৌরষ নিয়ে এসব মহামানবরা জন্মগ্রহন করে।
আশ্চর্যকথা এটাই, এদিকে যখন বুড়ীবালামের তীরে উপরওলা বাঙালীজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষকারের পরীক্ষা নিচ্ছেন, সেই সময়ে বিনোদবালার ডায়রীতে, ঐ একই দিনে একটা কবিতা লেখা হয়(পরে উদ্ধার হয়)যাতে ঈশ্বরের কাছে মনোবলের প্রার্থনা স্পষ্ট। এটাকে কি বলা যায়, ঘটনার সমাপতন?
গোবিন্দপুর গ্রামের কাছে, ভাদ্রের ভরা বুড়ীবালাম, সরকারি আদেশে সব নৌকা বাজেয়াপ্ত। নদী পার হয়ে বাবুরা দক্ষিণমুখো ভগুয়া গ্রামের কাছে গভীর জঙ্গলের দিকে চললেন। এ অঞ্চলের মানুষ, এতটাই পিছিয়ে যে সরকারী ঢ্যারা বিশ্বাস করলো। সাব ইন্সপেকটর চিন্তামনি সাহু সাদা পোষাকে হাজির ছিল, হঠাৎ যতীনকে জড়িয়ে ধরলো। দেশবাসীর জন্য যতীন গুলি ভরা পিস্তল রাখেন নি। একটা ঝটকা দিলেন। গুলতিতে ভরা পাথরের মত চিন্তামনি সাহু ছিটকে গেলেন। বাধা দুর হলো। সামনেই “অমৃত ” নদী। মাথায় পুটলী বেধে, ভরা বর্ষার নদী সাতরে পার হলেন পাঁচ বিপ্লবী।
চাষাখন্ড গ্রামের টিলায়, মজে যাওয়া, “দেশোয়া গরিয়া” জলার ধারে বসলেন পাঁচ বিপ্লবী। তিনদিন, পেটে দানা পড়েনি। নীরেনের একটা পা ক্ষতিগ্রস্হ। তিনি চিত্ত, মনোরঞ্জনকে অনুরোধ করলেন, তোরা দাদাকে বুঝিয়ে বল, আমার জন্য সবাই ধরা পড়ার মানে হয়না। রুখে দাড়ালেন দলনেতা, “কি এক যাত্রায় পৃথক ফল? আমরা মরলে, দেশবাসী জাগবে, এই যে গ্রামবাসী, যারা আমাদের ডাকাত ভাবছিল, হয়তো এতক্ষণে থানায় খবর পৌছে গিয়েছে (যতীনের অনুমান সঠিক ছিল), তারা অন্তত জানবে আমাদের পরিচয়। তাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, দেশটাকে স্বাধীন করতে এগিয়ে আসবে।”
এদিকে পাঁচজন পিস্তল ধারী আর অন্যদিকে বিপুল সেনা সমাবেশ, স্হানীয় শাসক কিলবি, রাদারফোর্ড একদিক দিয়ে আর কোলকাতা থেকে আসা সাহেবরা বিপুল সশস্ত্র সেনা, পুলিশ নিয়ে আরেক দিক থেকে। দুরপাল্লার রাইফেল। মেশিনগান।
ওদিকে চিত্তপ্রিয় দূরবীন দিয়ে দেখলেন, কিলবির নেতৃত্বে সশস্ত্র রাইফেলধারী পুলিশ এগিয়ে আসছে। অন্যদিকে রাদারফোর্ডের নেতৃত্বে আরেকদল। কিলবি দুরপাল্লার রাইফেল চালিয়ে বুঝিয়ে দিলো, “আমাদের ক্ষমতা”। সামনে দেশী সেনাদের রেখে সাদারা পিছনে। ভাঙ্গা মন নিয়ে সব্যসাচী যতীন দুহাতে মাউজার নিয়ে প্রস্তুত হলেন, দেশীয় মানুষ মারতে তার প্রান কাদে।
হঠাৎ নিখুত নিশানায় যতীন মাউজার চালালেন দুহাতে, পর পর। জনাদশেক ধানক্ষেতে চিতপাৎ। রাদারফোর্ড বাহিনী পিছু হটে গেলো। সেটা কিলবি বাহিনী দেখে ধানক্ষেতে শুয়ে পড়লো। ভাদ্রের ধানক্ষেত। পাঁচশো সেনার অবস্হা শোচনীয়। আসলে প্রখর বুদ্ধিমান যতীনের রনক্ষেত্র নির্বাচনটা সঠিক ছিল। একাধিক উইঢিপি,টিলা ও প্রাকৃতিক পরিখা। যুদ্ধ শুরু হয় দুপুরে। সন্ধ্যা হয় হয়। জন প্রতি একশো সেনা দুরপাল্লার রাইফেল নিয়ে এক পা ও এগোতে পারেনি। এদিকে বা হাতে যতীন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সেটা তুচ্ছ। ঐ হাতেই উনি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের গলা চেপে ধরেছিলেন।
যতীন তখন দেশীয় সেনাদের এড়িয়ে, সাদাদের টার্গেট করছেন। ফলে যেটা হচ্চে, সেটাকে ঠিক যুদ্ধ বলা যায়না। রাদারফোর্ড সেটা বুঝে দেশীয় সেনাদের এগিয়ে দিচ্ছেন। এই সময়ে চিত্তপ্রিয় ও যতীন, দুজনেই গুলিবিদ্ধ হলেন। চিত্তপ্রিয়, দাদা,বলে শেষ কথা বলে, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। যতীন, নিজের বা হাতে ও পেটে গুলি বিদ্ধ, চিত্তপ্রিয়র মাথাটা কোলে, ডান হাতে পিস্তল চালিয়ে যাচ্চেন। পঞ্চপাণ্ডবের একজন চলে গেলো। প্রতিশোধ নিতেই হবে।
যতীনের দ্বিতীয় হ্রদপিন্ড চিত্তপ্রিয় যদি অন্য কোথাও এভাবে চলে যেতেন, যতীন হয়তো চোখের জল রাখতে পারতেননা। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে দুর্বলতার কোন স্হান নেই। প্রকৃত বিপ্লবীর শিক্ষা। এমন সময় জ্যোতিষ পাল আরো গুরুতর খবর দিলেন, দাদা টোটা তো প্রায় শেষ। যতীন চামড়ার থলিটা এগিয়ে দিলেন, আরো দুদিন যুদ্ধ চালানোর রসদ। এদিকে আলো প্রায় স্তিমিত। যতীন বল্লো, এ যাত্রা বোধহয়, আমাদের ঠেকাতে পারলোনা। অন্ধকার নামলেই ঐ জঙ্গলে গিয়ে ঢুকবো।
একি অবস্থা। চামড়ার ব্যাগের চাবী কই ? ব্যাগটা প্রচন্ড পুরু ও ভারী। যতীন ব্যাগটা খোলার চেষ্টা করছেন,এমন সময়ে আরেকটা গুলি এসে বা হাতের আঙুলে লাগলো। রক্তে সারা গা ভেসে যাচ্ছে। ডান হাত এখনো সক্রিয়। মুস্কিল হলো, দেশীয় সেনাগুলো, পাল্লার মধ্যে আর শেতাঙ্গ শয়তান, সব রেন্জের বাইরে। অগত্যা, যতীন ডান হাতে নিখুত লক্ষে পিস্তল চালাচ্ছেন। প্রায় প্রতিটি গুলীতেই একজন না একজন আহত হচ্ছেন। কিন্তু ওনার লক্ষ হাত পা। মাথা, বুক কখনোই নয়। কারন ওরা যে এই দেশেই জন্মগ্রহন করেছে।
এদিকে জ্যোতিষের বুকের ডানদিকে একটা গুলি ফুড়ে বেরিয়ে গেলো। সারা গায়ে ক্ষত নিয়ে যতীন গুলি চালিয়ে যাচ্ছেন। নীরেন, মনোরন্জন সামনের ডোবা থেকে জল এনে সঙ্গীদের সেবা করে যাচ্ছেন। অন্ধকার দ্রুত নেমে আসছে।
যতীন ক্ষীনকন্ঠে জানালেন, নীরেন, মনোরঞ্জন, তোরা রইলি, মরার আগে দেশবাসীকে জানিয়ে যাস, আমরা ডাকাত নই, দেশবাসীকে আমাদের মহান ব্রতের কথা জানিয়ে যাস। দেশ জাগবে, আমাদের পথে।
আর কার্তুজ নেই। চামড়ার ব্যাগ ভর্তি কার্তুজ। খোলা যাচ্ছেনা। প্রায় তিন দিকেই প্রায় সাতশো সেনা, পুলিশ, হাতি, ঘোড়া, দুরে মোটরগাড়ী। মাঝখানে পাচজন বঙ্গসন্তান। দুজন নিহত, তিনজন গুরুতর আহত। বিপ্লবীরা আত্মসমর্পনের ইঙ্গিত দিলেন। আর কার্তুজ নেই।
সেনারা এগিয়ে এলো। রাদারফোর্ড অবাক হয়ে দেখলেন, এইসব পিস্তল দিয়ে পাচ শো, হাজার গজ দুরে এরা কি ভাবে নিখুত লক্ষ্যভেদ করছিল। এবার কুলি সংগ্রহ করে নীরেন ও মনোরঞ্জনের হাত বাধা হয়নি। এনারা আহতদের দেখাশোনা করছিলেন। যতীনের কথায় রাদারফোর্ড নীরেন ও মনোরঞ্জনকে যতীনের পাশে বসবার অনুমতি দেয়। মনোরঞ্জন সাগ্রহে যতীনের মাথা কোলে নিয়ে বসলেন। আর নীরেন নিলেন জ্যোতিষ পালের ভার। এবার খাটিয়া এনে দুজন গুরুতর আহত ও একজন নিহতকে খাটিয়ায় শোয়ানো হলে।
রনক্ষেত্রে রাদারফোর্ডের সৌজন্যের বিনিময়ে, যতীনও সৌজন্য দেখিয়েছিলেন। রাদারফোর্ড টুপিতে করে ডোবা থেকে রনক্ষেত্রে যতীনের জন্য জল নিয়ে এলে, যতীন তা গ্রহন করেন।
এদিকে তুমুল বৃষ্টি নামলো। বালেশ্বর হাসপাতালে অশ্বারোহী দূত মারফৎ খবর গেলো। কিলবিকে যতীন, ঐ অবস্হাতেও জানালো, “আমার ছেলেদের প্রতি যেন অবিচার না হয়, যা কিছু হয়েছে আমার নির্দেশে। সব কিছুর জন্য, আমি দায়ী। “.
রাত এগারোটা। বিশাল মিছিল বালেশ্বর সরকারি হাসপাতালের দিকে এগিয়ে চলেছে। এদিকে গ্রামবাসীরা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু বহু দেরী হয়ে গেছে। তারা অনুতাপ করতে শুরু করেছে। বিক্ষোভের ভয়, হাসপাতালে সেনা মোতায়েন হলো।
সশস্ত্র প্রহরী নিয়ে হাসপাতালে ঢুকলেন সার্জন খান বাহাদুর রহমান, সহকারী সার্জন গাঙ্গুলি। একজন লেডী ডাক্তার,দুজন কম্পাউন্ডার, চারজন নার্স, তিনজন কুলি, দুজন মেথর। যতীনের উর্ধাঙ্গ অবারিত। বাম হাতের আঙ্গুল, দুটি মেটাকার্পাল অস্থি গ্রন্থি গুড়ো হয়ে গেছে। তলপেট ও নাভির দুদিকেই রাইফেলের বুলেট। ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ডাক্তার লিখলেন, যবনিকা পতনের আর দেরী নেই।
মহান শহীদ চিত্তপ্রিয়ের মৃতদেহ চলে গেলো মর্গে। নীরেন ও মনোরঞ্জনের প্রাথমিক চিকিৎসার পর হাজতে নিয়ে যাওয়া হলো।
যতীনকে অপারেশান রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। রক্তবমি হচ্ছে। কিলবি নিজের হাতে লেমনেড খাইয়ে দিলেন, কোলকাতা থেকে নির্দেশ এসেছে, বাঁচিয়ে রাখতেই হবে, বহু আন্তর্জাতিক যোগায়োগের মূলসুত্র বাংলা মায়ের এই সন্তান, বিশ্বের একমাত্র মানুষ যে শৈশবে পাগলা ঘোড়া থামিয়ে দেয়, কৈশোরে খালি হাতে রয়্যাল বেঙ্গল হত্যা করে। হাজার গজ দুর থেকে পিস্তল দিয়ে নিখুত লক্ষভেদ করে। এর কাছে না জানি কত খবর থাকবে।
এমন নজির ইতিপূর্বে দেখেননি বলে মেনে নিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ কুশীলবেরা। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ সালে সূর্যাস্তের সঙ্গে অবসান হল এই যুদ্ধের। পরদিন বালেশ্বর সরকারী হাসপাতালে যতীন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
শ্রীঅরবিন্দ লিখছেন, ‘তিনি (বাঘা যতীন) ছিলেন অভিনব ব্যক্তি। মানবতার পুরোভাগে ছিল তাঁর ঠাঁই। এমন সৌন্দর্য ও শক্তির সমন্বয় আমি দেখিনি, আর তাঁর চেহারাই ছিল যোদ্ধার অনুরূপ।’ বিপ্লবী অতুলকৃষ্ণ ঘোষ লিখেছেন, ‘শিবাজীর মতো রণকুশলী ও চৈতন্যের মতো হৃদয়বান একাধারে পেলে আমরা পাই যতীন্দ্রনাথকে।’ তাঁকে ‘ভারতীয় বিপ্লবের গ্যারিবল্ডি’ বলেছিলেন যদুগোপাল মুখোপাধ্যায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি অকুতোভয়। স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। প্রতিদিন গীতা পাঠ করতেন। সে অভ্যেস তাঁর রয়ে গিয়েছিল আজীবন। মহুলডিহার শালবনে অজ্ঞাতবাসে থাকার সময়ও শিলাসনে বসে উদাত্ত গলায় গীতা পাঠ করতেন। সাক্ষী ছিলেন তাঁর সঙ্গী নলিনীকান্ত কর। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা সেই অপরূপ রূপ দেখতে দেখতে আত্মহারা হয়ে যেতাম। মনে হত যেন গৌতম মুনি স্বয়ং বেদমন্ত্র উচ্চারণ করছেন।’
আজ সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখ চলে গিয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথ। স্মরণ করি পরম শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়।
ঋণ: ১) চতুরঙ্গ , ২) আনন্দবাজার আর্কাইভস