
. অমিত মালী
সামনেই ১৬ই আগস্ট আসছে দিন। ১৯৪৬এর কলকাতার রক্ষাকর্তা শ্রী গোপালচন্দ্র মুখার্জির স্মরণ দিবস। সেই সময় কলকাতায় মুসলিম লীগ হিন্দুদের ওপর যে হত্যালীলা চালিয়েছিল, তাঁর প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন গোপালচন্দ্র মুখার্জি এবং তাঁর ভারত জাতীয় বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু কলকাতার রক্ষায় এবং তাঁর সহযোগী হিসেবে আর একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন শ্রী হরেন ঘোষ- যিনি মুসলিম লীগের হিন্দু হত্যা এবং কলকাতায় হত্যালীলা চালানোর পরিকল্পনার খবর গোপালচন্দ্র মুখার্জির কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
হরেন ঘোষ স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন এবং কংগ্রেসের জনপ্রিয় নেতাও ছিলেন। সেইসঙ্গে সংগীত, সিনেমা এবং শিক্ষা প্রসার নিয়ে তাঁর ব্যাপক উৎসাহ ছিল। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে যশোরে, মামার বাড়িতে। আদতে তাঁর পরিবার হাওড়া জেলার লোক ছিলেন। তিনি হাওড়া জেলার জনপ্রিয় কংগ্রেস নেতা ছিলেন। সেইসঙ্গে তিনি বিশ্বভারতীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। যেসময় বিশ্বভারতী আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত ছিল, সেসময় হরেন ঘোষ প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। এছাড়াও নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করকেও তিনি অর্থ সাহায্য করেছিলেন। সেইসঙ্গে সিনেমা এবং সঙ্গীতশিল্পীদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজও করেছিলেন তিনি।
হরেন ঘোষ কংগ্রেসের হাওড়া জেলার জনপ্রিয় নেতা হওয়ার সুবাদে রাজনৈতিক মহলে তাঁর পরিচিতি ছিল ব্যাপক। হরেন ঘোষ তাঁর ধর্মতলার অফিসে বসতেন এবং সেখান থেকেই বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী সংগঠনের নেতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সেই সূত্রে গোপালচন্দ্র মুখার্জি এবং তাঁর ”ভারত জাতীয় বাহিনী”-এর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এছাড়াও স্বাধীনতা সংগ্রামী নরেন্দ্র দেব( নবনীতা দেবসেন-এর পিতা), হরেন ঘোষের বিশেষ বন্ধু ছিলেন।
১৯৪৬ এর উত্তাল সময়ে মুসলিম লীগের দাবি ছিল পাকিস্তান। সেইসঙ্গে ছিল লড়াই করে পাকিস্তান ছিনিয়ে নেবার ডাক। কিন্তু বাঙালি হিন্দু তখন বুঝতে পারেনি যে, লড়াই কার বিরুদ্ধে। ফলে সকলের মধ্যে একটা ধোয়াঁশা ছিল। আর সেই কারণেই বাঙালি হিন্দু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলো।
কলকাতার রক্ষাকর্তা গোপালচন্দ্র মুখার্জির কথা অনুযায়ী ধর্মতলার যে ফ্ল্যাটে হরেন ঘোষের অফিস ছিল, তাঁর পাশের ফ্ল্যাটে এক বাঈজী ভাড়ায় থাকতেন। সেই বাঈজীর কাছে সে সময়ের বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আসতেন। আসতেন সেই সময়ের বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন সোহরাবর্দি। পাশেই অফিস হওয়ার কারণে হরেন ঘোষকে চিনতেন ওই বাঈজী। ১৯৪৬-এর জুলাই মাসের শেষের দিকে একদিন সন্ধ্যায় ওই বাঈজীর ফ্ল্যাটে আসেন হোসেন সোহরাবর্দি এবং মুসলিম লীগের বেশ কয়েকজন নেতা। তাঁরা ওখানে অধিক মদ্যপান করেন অনেক রাত পর্যন্ত। তারপর ওখান থেকে চলে যান। কিন্তু নেশার ঘরে হোসেন সোহরাবর্দি ও তাঁর সঙ্গীরা একটি কাগজ ফেলে চলে যান। বাঈজী ওই কাগজ কুড়িয়ে পান এবং কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাগজ মনে করে পরেরদিন সকালে হরেন ঘোষকে দেখান। হরেন ঘোষ কাগজ দেখে তাঁর গুরুত্ব বুঝতে পারেন। কিন্তু বাঈজীর সামনে বলেন যে এটা একটা বাজে কাগজ এবং ভিতরে থাকা ডাস্টবিনে ফেলে দেন। কিন্তু বাঈজী চলে যাওয়ার পরে সেই কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে হরেন ঘোষ চলেন যান তাঁর বন্ধু গোপালচন্দ্র মুখার্জির কাছে।
কি ছিল সেই কাগজে? সেই কাগজে ছিল ডাইরেক্ট একশন ডে-এর বিস্তারিত পরিকল্পনা। গোপালচন্দ্র মুখার্জি আমেরিকান সাংবাদিক Andrew Whitehead-কে সাক্ষাৎকারে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, সে কাগজে ছিল কলকাতার কোন কোন এলাকায় মুসলিমরা ঝাঁপিয়ে পড়বে, কোন কোন বিখ্যাত হিন্দু ব্যক্তিদের খুন করা হবে, তার বিস্তারিত পরিকল্পনা। সেইসঙ্গে ছিল যে গঙ্গা নদীর পূর্ব দিকটার পুরোটাই হবে পাকিস্তান। দখল করা হবে শিয়ালদাহ স্টেশনসহ শহরে থাকা হিন্দুদের দখলে থাকা গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলি। এছাড়াও, হাওড়া ব্রিজ ভেঙে কলকাতাকে বিচ্ছিন্ন করারও পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু হরেন ঘোষের দ্বারা সেই পরিকল্পনার কথা জানতে পারেন গোপালচন্দ্র মুখার্জি। ফলে কলকাতায় হত্যালীলা চালানোর পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। সেইসঙ্গে মুসলিম লীগের গুন্ডাদের শক্তহাতে প্রতিরোধ করেন গোপালচন্দ্র মুখার্জি এবং তাঁর ভারত জাতীয় বাহিনীর সদস্যরা। পাল্টা মারে মুসলিম লীগের কর্মীদের তখন দিশেহারা অবস্থা। এমনকি মুসলিমদের বাঁচাতে আসরে নামতে হয় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে। তিনি গোপালচন্দ্র মুখার্জিকে অস্ত্র সমর্পনের অনুরোধ করেন। কিন্তু গোপালচন্দ্র মুখার্জি সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।
এরপরে হরেন ঘোষের কি হয়েছিল? গোপালচন্দ্র মুখার্জির বক্তব্য অনুযায়ী, হরেন ঘোষ মুসলিম লীগের এই ঘৃণ্য পরিকল্পনার কথা জওহরলাল নেহেরুকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু নেহেরু হরেন ঘোষের কথাকে গুরুত্ব দেননি। কিন্তু হরেন ঘোষের এই ভূমিকার কথা মুসলিম লীগের নেতারা জানতে পেরেছিলেন। তার ফলে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে হরেন ঘোষকে নৃশংসভাবে খুন হন। খুন করেন ওয়াসেন মোল্লা নামক একজন মুসলিম লীগ কর্মী। কিভাবে খুন হয়েছিলেন তিনি ? এব্যাপারে স্বাধীনতা সংগ্রামী নরেন্দ্র দেব, যিনি নবনীতা দেবসেন-এর পিতা, তাঁর বক্তব্য জানলে পরিষ্কার হয়। নবনীতা দেবসেন তাঁর ছোটবেলার স্মৃতিতে লিখেছেন যে তাঁর বাবার বন্ধু হরেন ঘোষকে খুন করা হয় এবং দেহকে টুকরো টুকরো করে একটি কাগজের বাক্সতে ফেলে যায় মুসলিম লীগের কর্মীরা। তাঁর টুকরো করা দেহাংশ ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল তাঁরই ধর্মতলার অফিসে। তবে হরেন ঘোষকে মুসলিম পরিকল্পনার কাগজটি পৌঁছে দেওয়া সেই বাঈজীর আর কোনো খবর পাওয়া যায়না ইতিহাসে। বাঙালি ভুলে গিয়েছে হরেন ঘোষকে। ভুলে গিয়েছে সরকারও। শুধু হাওড়ার নাগরিক সমাজ নিজেদের উদ্যোগে হরেন ঘোষের মূর্তি স্থাপন করেছিল হাওড়া ময়দানে। আজও সেই মূর্তি রয়েছে, শুধু বাঙালি হিন্দুর শ্রদ্ধা পায়না সেই মূর্তি।
Like this:
Like Loading...
Related