বাড়ি বসে খাবার আনার জনপ্রিয় app হল জোমাটো এবং উবার ইটস। তবে তাদের অফিসিয়াল টুইটার একাউন্ট থেকে একটি বিতর্কিত টুইটকে কেন্দ্র করে তুলকালাম বেঁধে গেল সামাজিক মাধ্যমগুলোয়। প্রথম দিকে কিছু বাহবা এবং হাততালি কুড়োলেও খুব শিগগিরই টুইট দুনিয়া সম্পুর্ন বিপক্ষে চলে যায় এই দুই কোম্পানির। টুইটারে টপ ট্রেন্ড হয়ে ওঠে #boycottzomato এবং #BoycottUberEats । ঘটনার সূত্রপাত পন্ডিত অমিত শুক্লা নামের এক গ্রাহকের জোমাটোর প্রতি টুইট দিয়ে। তিনি অভিযোগ করেন, হিন্দুদের পবিত্র শ্রাবণ মাসে জোমাটো এক অহিন্দু ডেলিভারি বয়কে দিয়ে খাবার পাঠানোয় তিনি সেটা খেতে অপারগ। তাই তিনি খাবারের অর্ডার বাতিল করছেন এবং জমাটোর তরফ থেকে তাঁকে খাবারের দামটা ফেরৎ দেওয়া হোক। এর উত্তরে জোমাটোর অফিসিয়াল টুইটার হ্যান্ডেল @ZomatoIN থেকে যা লেখা হয়, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়- “খাবারের কোন ধর্ম হয় না। কারণ, খাবার নিজেই একটি ধর্ম।” কোম্পানির এই অবস্থানকে সমর্থন জানিয়ে নিজেও টুইট করেন জোমাটো র অন্যতম প্রধান দীপেন্দ্র গোয়াল। এতে কেউ কেউ প্রশংসা করেন জোমাটো-র অসাম্প্রদায়িক অবস্থানের। কিছু জন হ্যাশট্যাগে সমর্থন জানিয়ে লেখেন, “আমি অমিতের পাশে নেই”! #IDontStandWithAmit
তারপরই প্রকাশ্যে আসে জোমাটোর পুরোনো কয়েকটি টুইট। একটিতে দেখা যায় মহম্মদ আশরাফ নামের এক গ্রাহক জোমাটো ব্যবহার করে একটি রেস্তোরাঁ থেকে ভেজ পিজ্জা অর্ডার করতে চলেছেন। কিন্তু সেই হোটেলের মেনুতে শুয়োরের মাংস বা পর্কের বিভিন্ন পদ রয়েছে বলে তিনি অর্ডার বাতিল করছেন। এবং জোমাটো কেন তাকে এই বিষয়টা আগে জানায়নি সে নিয়ে অভিযোগ করেছেন। এক্ষেত্রে জোমাটো অবশ্য “খাবারের কোন ধর্ম নেই” দাবি না করে, গ্রাহকের অভিযোগ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছে।
আরো একটি টুইট নজরে আসে, যেখানে ওয়াজিদ নামের একজন বিরিয়ানি অর্ডার দিয়েছেন জোমাটো থেকে। কিন্তু সেটি হালাল নয় জানতে পেরে তিনি খাবারের অর্ডার বাতিল করছেন এবং এ বিষয়ে জোমাটোর কাছে অভিযোগ জানাচ্ছেন। এই ক্ষেত্রে আবার জোমাটো গ্রাহকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে।
অনেকে জোমাটো app খুলে ছবি পাঠান, যেখানে দেখা যাচ্ছে গ্রাহকের সব থেকে কাছে কোথায় হালাল খাবার পাওয়া যাবে, তার স্পষ্ট রূপরেখা দেওয়া আছে ওই app-এ। কোন শহরে কটা হালাল রেস্তোরাঁ আছে, তাও পরিষ্কার দেখিয়ে দিচ্ছে ওই app। এমনকি জমাটো-তে নিজের প্রোফাইল খুলতে গেলে, ধর্ম জানাতে হচ্ছে বলেও app থেকে ছবি তুলে পাঠান একজন।
এরপরই সাম্প্রদায়িক দ্বিচারিতার প্রশ্নে জোমাটো-র বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে টুইটার। প্রশ্ন ওঠে, একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের আচরণ দুটো সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে দুরকম কেন? খাবারের যদি ধর্ম নাই থাকবে তাহলে কোন রেস্তোরাঁর হালাল সার্টিফিকেট পেতে সেখানে অন্ততঃ দুজন মুসলিম রাঁধুনি রাখা বাধ্যতামূলক কেন? কোন মাংসকে হালাল করতে গেলে কেন কসাইটিকে সেই বিশেষ ধর্মের হতে হবে? এবং হালাল সার্টিফিকেট পাওয়া কোন রেস্তোরাঁ সত্যিই হালাল পদ্ধতি অনুসরণ করছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করতেও ওই বিশেষ ধর্মেরই পরিদর্শকদেরই আনতে হবে? অহিন্দুর হাত থেকে খাবার নিতে না চাওয়া অমিত শুক্লা যদি অস্পৃশ্যতার দোষে দোষী হন, তাহলে হালাল ছাড়া ব্যবহার না করা গ্রাহকরা কি সেই একই অস্পৃশ্যতার দোষে দোষী নন? এবং যে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হালাল নিয়ে কোন আপত্তি নেই, তারা কিভাবে পন্ডিত অমিত শুক্লা-কে জ্ঞান বিতরণ করতে পারে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। সকলেই মত দেন, হয় দুটোই ব্যক্তির খাদ্য-স্বাধীনতা অথবা কোনোটাই নয়।
“খাবারের কোন ধর্ম নেই” কথাটার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকে। খাস কলকাতাতেই যেখানে হালাল ছাড়াও রয়েছে, “মুসলিম হোটেল” এবং “আদর্শ হিন্দু হোটেল”, সেখানে এই ধরণের কথা কতটা যুক্তিযুক্ত। কোন হোটেলের খাবারের মেনু খুললেই যেখানে লেখা থাকে কোন খাবারটা জৈনদের জন্য অর্থাৎ পিঁয়াজ-রসুন-আলু বর্জিত, কোন খাবারটা হিন্দু ব্রতর উপবাসের জন্য, আয়োজন করা হয় ইফতার বা নবরাত্রির স্পেশাল থালির। দুর্গাপূজা বা সরস্বতী পূজায় ভোগ থালিরও ব্যবস্থা করে অনেক বাঙালি রেস্টুরেন্ট। তাছাড়া কোন হিন্দু ডেলিভারি বয় কি রান্না করা গোমাংস ডেলিভারি দিতে চাইবে? অথবা কোন মুসলিম ডেলিভারি বয়কে দিয়ে কি কোন শুয়োরের মাংসের রান্না ডেলিভারি করানো যাবে? সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র সুশীলতার প্রমাণ দিতে এই ধরণের গালভরা অযৌক্তিক কথা কতদূর বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে!
এরপরই টুইটারে আসতে থাকে #boycottzomato নামে একের পর এক টুইট। উবের ইটস তাদের টুইটার হ্যান্ডেল @UberEats_IND থেকে জমাটো কে সমর্থন জানালে তাদের বিরুদ্ধেও বয়কটের হ্যাশট্যাগ ওঠে #BoycottUberEats বলে। বহু মানুষ ছবি পোস্ট করেন উবার ইটস এবং জমাটো app আন ইন্সটল করে দেবার। ওয়ান স্টার রেটিং দেওয়াও শুরু করেন অনেকে জোমাটো app এ গিয়ে। কয়েক ঘন্টার ভিতরে দেখা যায় জমাটোর সমর্থনে টুইট হ্যাশট্যাগ কে বহুগুণে ছাড়িয়ে গিয়েছে জমাটো এবং উবার ইটস এর বিরুদ্ধে হ্যাশট্যাগ। টুইটারে টপ ট্রেন্ডিং হয়ে ওঠে #boycottzomato এবং #BoycottUberEats । পন্ডিত অমিত শুক্লার পাশে দাঁড়াতে #IStandWithAmit ও টুইট করেন অনেকে।
সাম্প্রদায়িক দ্বিচারিতার কারণে একনাগাড়ে বাজে রিভিউ আসতে থাকায় app এর রেটিংও পড়তে থাকে জোমাটোর। শেষ খবর পাওয়া অব্দি সব হ্যাশট্যাগ মিলিয়ে 50 হাজারের বেশি টুইট হয়েছে জমাটোর দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে আর পক্ষে মাত্র 2-3 হাজার। অবস্থা এমন চরমে পৌঁছেছে যে আজও টুইটারের টপ ট্রেন্ড রয়েছে #ZomatoExposed ।
একটা টুইট থেকে যে এমন লঙ্কাকান্ড বেঁধে যাবে, সেটা বোধ হয় ভাবতেও পারেননি জমাটো, উবার ইটস এর কর্ণধাররা। নিরপেক্ষ মানুষজনরা বলছেন, পেশাদারিত্বের দিক থেকেও এই ধরণের উত্তর দেওয়া ভুল হয়েছে জোমাটোর। কারণ জোমাটো একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। গ্রাহকের রুচি তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। সেটা নিয়ে মন্তব্য না করে বা জ্ঞান না দিয়ে পেশাদার ভাবেও এর উত্তর দেওয়া যেত। গ্রাহকের অনুরোধ রাখতে কোন কোম্পানি বাধ্য নয়। কাজেই সেই অনুরোধ রাখার অপারগতা টুকু জানালেই যেখানে চলত, সেখানে অযথা খাবারের সাথে ধর্মীয় রাজনীতিকে না জড়ালেই কি চলছিল না? জোমাটোর এই টুইট-কান্ড সমস্ত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। অসাম্প্রদায়িকতার নাম করে সাম্প্রদায়িক দ্বিচারিতা যে আর চলবে না, চোখে আঙুল দিয়ে তাই শেখাচ্ছে নতুন ভারত।
তথ্যসূত্র:-
১) https://www.bbc.com/news/uk-27324224
২) https://theprint.in/…/zomato-app-gets-1-star-rating…/271063/
৩) https://www.icv.org.au/…/what-is-halal-a-guide-for-non-mus…/
৪) https://www.theguardian.com/…/what-does-halal-method-animal…
৫) https://www.halaltransactions.org/apply-for-halal-services