স্মৃতিলেখা চক্রবর্তী
আমাদের ছোটবেলায় এত বিরিয়ানি-টিরিয়ানির চল ছিল না। চপ-কাটলেট, পরোটা-মোগলাই, এসবই তখন বাঙালির প্রিয় খাদ্য ছিল। বাজারের আশেপাশের দোকানগুলোয় সন্ধ্যে নামলেই রমরমা ব্যবসা শুরু হয়ে যেত। মস্ত চাটুর মাঝখানে গনগনে আঁচে টগবগ করে ফুটত কালচে পোড়া তেল। তাতে উল্টে পাল্টে এ পিঠ ও পিঠ করে ভাজা হত মুচমুচে মোগলাই। কিংবা বিস্কুটের গুঁড়োয় মোড়া ভেটকির ফিসফ্রাই। আর ছিল পাড়ার মোড়ে মোড়ে নিরামিষ তেলেভাজার দোকান। সকালে গরম কচুরি-জিলিপি, আর বিকেল নামলেই আলুর চপ, বেগুনি, পিয়াজি এসবের পসরা সাজত। রোল-চাউয়ের ঠেলাও ছিল। তবে ভাজা-পোড়া খাবারের প্রতি বাঙালির তীব্র আকর্ষণকে সেগুলো খুব একটা টেক্কা দিতে পারেনি।
এরপর হঠাৎ একদিন কি যে হল। সব হিসেব ওলট-পালট করে গোটা কলকাতা জুড়ে ছোট বড় বিরিয়ানির দোকান খুলতে লাগল। আলু, ডিম আর মাংসের টুকরো দেওয়া লম্বা চালের নোনতা পোলাও। বাজারে আসতেই সুপার হিট। দেদার বিক্রি। বিক্রি যত বাড়তে লাগল, দোকানের সংখ্যাও তত বাড়তে লাগল। বিরিয়ানি মহল, বিরিয়ানি সেন্টার, আলিবাবা, নানান নামে বিরিয়ানি ব্যবসা। দু পা হাঁটলেই বিরিয়ানির দোকান। ঢাকাই বিরিয়ানি, কলকাতা বিরিয়ানি, হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি ইত্যাদি নানান বিরিয়ানির সম্ভার আক্ষরিক অর্থেই একটা বিরিয়ানি যুগের সূচনা করল। এরপর শুরু হল বিরিয়ানির দোকানে দোকানে টক্কর। কে কত ভাল বিরিয়ানি বানাতে পারে-র থেকেও বড় কথা হল, কে কত বিশুদ্ধ বিরিয়ানি বানাতে পারে। নিজেদের বিরিয়ানির বিশুদ্ধতা প্রমাণ করতে, দোকানগুলো নানা রকম কলা-কৌশল অবলম্বন করল। এদের মধ্যে কিছু দোকান, যারা একটু অতিরিক্ত বুদ্ধিমান, তারা রটিয়ে দিল, তাদের দোকানে খাঁটি মুসলমান রাঁধুনি দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করা হয়। এই প্রচারে বিপুল সাড়া মিলল। সব বাঙালিই মানে, বিরিয়ানি হল খাঁটি মুসলমানি রান্না। কাজেই মুসলমানি রান্না মুসলমানের থেকে ভাল কে রাঁধবে। যে বাঙালি দোকান থেকে কষা মাংস খাওয়ার আগে কখনো জানতে চায়নি, এর রাঁধুনি খাঁটি বাঙালি কিনা; সেই বাঙালিই দলে দলে ছুটল মুসলমান রাঁধুনির রাঁধা “খাঁটি বিরিয়ানি” খেতে।
মুসলমান ব্যবসায়ীরা এই ট্রেন্ড চিনতে ভুল করেনি। বাঙালি যে “খাঁটি বিরিয়ানি” বলতে তাদেরকেই বোঝাচ্ছে, এটা বাঙালি ক্রেতার হাবেভাবে বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছিল। শুরুটা হল বড় দোকান গুলো দিয়ে। হঠাৎই বাঙালি পাড়ায় শাখা খুলতে শুরু করল আরসালান, আমিনিয়া, হাজী বিরিয়ানি, রহমানিয়ার দল। তারপরের ধাপে বাঙালি বিরিয়ানির দোকানগুলোর বদলে আসতে শুরু করল আসমা বিরিয়ানি, বরকত বিরিয়ানির মত দোকান। যেসব বাঙালি পাড়ায় আগে একটিও মুসলমান দোকান ছিল না, সেখানে বিরিয়ানির হাত ধরে একের পর এক পাখা মেলতে লাগল আসমা, বরকত, ফাতেমা, রহিমা-রা। মুখে তাদের মিষ্টি হাসি, আর মাথার উপর লেখা সাতশো ছিয়াশী। আমি একে “বিরিয়ানি বিপ্লব” নামেই ডাকব, যে বিপ্লবের দখল মুসলমানেরা বাঙালির থেকে নিঃশব্দে কেড়ে নিয়েছে ।
বিরিয়ানি বিপ্লবের সাথে সাথে প্রায় নিঃশব্দে ঘটে গেল আরেকটা জিনিস। মুসলমানের বিরিয়ানির দোকানের হাত ধরেই বাঙালির খাবার প্লেটে ঢুকে পড়ল হালাল সংস্কৃতি। বিরিয়ানির লোভে গোগ্রাসে গেলা বাঙালি পাত্তাই দিল না যে সে হালাল খাচ্ছে। হালাল কি, হালাল কেন, সেটা সম্বন্ধে কিছু জানার আগেই হালাল খাওয়া নিয়ে বাঙালির মানসিক বাধা তৈরি হবার আগেই শূন্য হয়ে গেল। এখন KFC র মুরগি ভাজা থেকে মিত্র ক্যাফে-র ফাউল কাটলেট হালাল হলেও বাঙালির কিছু যায় আসে না।
এতকিছু , কারণ বাঙালি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, বিরিয়ানি একটি মুসলিম খাবার। তাই, মুসলমানে চাল-মাংস ছুঁয়ে দিলেই সুস্বাদু কাবাব বিরিয়ানি তৈরি হয়ে যায়। বিরিয়ানির সাথে মুসলমানের সম্পর্ক নিয়ে বাঙালির এই মনোভাবের কথা আমি জানতেও পারতাম না, যদি না আমার এক অতিবাম স্কুলপাঠী ঠিক এই ঢঙে আমাকে এই কথাটা বলত। বিরিয়ানির মত প্রাক-ইসলামী যুগের রান্না নিয়ে এমন মনোভাব কেউ রাখতে পারে, কথাটা শুনেও ঠিক বিশ্বাস হয়নি। তবে ফেসবুকে বিভিন্ন খাবার গ্রূপে ঘুরে বিরিয়ানি সম্বন্ধে বাঙালির মনোভাব পড়ে আর অবিশ্বাস করতে পারিনি।
আজকে যদি বাঙালিদের ধরে ধরে প্রশ্ন করা হয়, তাদের প্রিয় খাবার কি, ১০০ জনের মধ্যে ৯০ জন বাঙালিই হয়তো উত্তর দেবে- বিরিয়ানি। বিরিয়ানি নিয়ে আমার ব্যক্তিগত আদিখ্যেতা না থাকলেও, “বিরিয়ানি বিপ্লব”-এর পর গোটা পশ্চিমবঙ্গে বিরিয়ানির বাজার ঠিক কতটা বড়, তার ধারণা করতে পারি। রাস্তায় ঘাটে, বাজার হাটে, বিরিয়ানির দোকান এখন সর্বত্র। এখন প্রশ্ন হল এই বিরিয়ানির দোকানগুলোর মধ্যে বাঙালির দোকান ঠিক কত শতাংশ? বিরিয়ানি ব্যবসার কতটুকু লাভ বাঙালি ব্যবসায়ীরা পাচ্ছে? আরসালানের বিপুল ভিড় আর হাজি-র দোকানে বিশাল লাইন দেখে বিশ্বাস করতে ভরসা হয় না, বিরিয়ানি বিপ্লবের খুব বেশি লাভ বাঙালি পাচ্ছে। হয়তো দোষ সেই বাঙালি দোকানগুলোরই, যারা মুসলমান রাঁধুনি দেখিয়ে খদ্দের টানতে গেছিল। তারাই বাঙালি ক্রেতার মাথায় ঢুকিয়েছে বাঙালি রাঁধুনি অত ভাল বিরিয়ানি রাঁধতে পারবে না। সেক্ষেত্রে আর মাঝখানে শিখন্ডী রাখা কেন? চালাও পানসি আরসালান-আমিনিয়া। বাংলায় সব বিপ্লবেরই বোধয় একই পরিণতি হয়। বাঙালির কোলেপিঠে বড় হয়ে বিপ্লব একদিন বাঙালিকে ছাড়িয়ে অন্যত্র চলে যায়।