বাংলাদেশে পুলিসের জালে কুখ্যাত জঙ্গিনেত্রী। গত ৫ই এপ্রিল, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে নাবিলা ওরফে হুমায়ারাকে। জেহাদি সংগঠন নব্য জেএমবির মহিলা শাখা ‘ব্যাট উইমেন’-এর প্রধান সে। গোয়েন্দাদের কাছে ওই জঙ্গি নেত্রী ‘ব্যাট উইমেন’ হিসেবেই পরিচিত। বহুদিন ধরেই তাকে হন্য হয়ে খুঁজছিল বাংলাদেশ পুলিস। অবশেষে গোপন সূত্রে খবর পেয়ে ঢাকার অভিজাত এলাকায় অভিযানে নামে পুলিসের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। পাকড়াও করা হয় নাবিলাকে।
গত বছর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের মৃত্যু দিবসে হামলার ছক বানচাল করে বাংলাদেশ পুলিস। ধানমাণ্ডির ৩২ নম্বরে মন্ত্রী-এমপিসহ শতাধিক মানুষকে হত্যার যে ছক কষেছিল জঙ্গিরা, সেই পরিকল্পনা এবং অর্থ ঢালার সঙ্গে জড়িত ছিল নাবিলারা। সেদিন ঢাকার একটি অভিজাত হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে অভিযান চালিয়ে ভয়াবহ নাশকতার পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়া হয়। অভিযানে সাইফুল নামে এক জঙ্গি আত্মঘাতী হয়। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, এতদিন নাবিলার উপর নজর রাখা হচ্ছিল। অন্তঃসত্ত্বা থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
নাবিলার বাবা জাকির হোসেন ঢাকার হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজার মালিক। দুই ভাইবোনের মধ্যে নাবিলা ছোট। ভিকারুন্নিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হয় নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে তাজরিন খানম শুভর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। শুভর ভাই আকরাম হোসেন নিলয় নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা। শুভর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে হুমায়ারা ওরফে নাবিলাও। এরপর ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে নব্য জেএমবির সিস্টার উইংয়ের প্রধান। জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার পর নাবিলা নব্য জেএমবির সিক্রেট যোগাযোগ অ্যাপে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেখানে নাবিলা নিজের আইডি খুলেছিল ‘ব্যাট উইমেন’ নামে। ফলে ব্যাট উইমেন নামেই সংগঠনের অন্য সদস্যরা তাকে চিনত। নাবিলার সঙ্গে আরও অন্তত ১০-১২ জন মেয়ে নব্য জেএমবির সিস্টার উইংয়ে কাজ করত বলে জানা গিয়েছে। বিত্তশালী জঙ্গি সমর্থকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গোপনে তা দলের কাছে পৌঁছে দিত নাবিলা।
নাবিলার স্বামী তানভির ইয়াসিন করিমকে গ্রেপ্তার করা হয় গত বছরের ১৯ নভেম্বর। তানভিরও ধনী পরিবারের সন্তান। আগে থেকেই দু’জন পরিচিত হওয়ায় তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। দু’জনই জঙ্গি কাজে জড়িয়ে পড়ে একসঙ্গে। যদিও গ্রেপ্তারের পর নাবিলার স্বামী তানভির ইয়াসিন করিম কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্তাদের কাছে বলেছে, স্ত্রী নাবিলার প্রভাবেই জঙ্গিবাদে জড়ানো ও সাংগঠনিক কাজে অর্থ সংগ্রহ ও সরবরাহ করত সে। জঙ্গি কাজকর্মের বাইরে সে ইসলামি বই প্রকাশনার কাজ করত। তার একাধিক প্রকাশনা সংস্থা রয়েছে।
এর আগে বুধবার জঙ্গিদের সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে বেগম রোকেয়া কলেজের এক ছাত্রীকে গ্রেপ্তার করে পুলিস। সে জেএমবি’র তামিম গ্রূপের সদস্য। জঙ্গিদমন শাখার উপ-কমিশনার মহম্মদ মহিবুল ইসলাম খান জানান, লালমনিরহাট জেলা থেকে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সাদিয়া আফরোজ ওরফে নিনাকে (২৪) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশে জোরকদমে জেহাদিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে শেখ হাসিনা সরকার। জঙ্গি নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দিতে একের পর এক অভিযান চলছে দেশজুড়ে। শেষ সংযোজন নব্য জেএমবি-র মহিলা শাখা ‘ব্যাট উইমেন’-এর প্রধানকে পাকড়াও করা।
বাংলাদেশে ২০১৬ সালের জুলাইতে গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর দেখা গিয়েছিল, শিক্ষিত বিত্তবান পরিবারের ছেলেরা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়েছে। এখন কি সেই একই ধারায় মহিলারাও যুক্ত হচ্ছে জঙ্গিবাদে? বাংলাদেশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের উপ-কমিশনার মহম্মদ মহিবুল ইসলাম খান জানিয়েছেন, জঙ্গি কর্মকাণ্ডে মেয়েদের যুক্ত হওয়ার হার এখনও কম হলেও, এই সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু আগে যেখানে শুধুমাত্র পরিবারের প্রভাবে জড়িয়ে যেত মেয়েরা, এখন তেমন নয়। অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই জড়িত হচ্ছে জঙ্গি কাজে। মহিবুল জানিয়েছেন, ‘বছর খানেক আগে আমরা কয়েকজন মহিলাকে এই অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছিলাম। দেখা গিয়েছে পরিবারের অর্থাৎ বাবা, স্বামী বা ভাই এমন কারও সূত্রে জঙ্গি তৎপরতার তারা জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, শুধু পরিবারের প্রভাবেই তারা জড়িয়ে পড়ছে না। বরং সেটা নিজে নিজেই। নাবিলার ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য।’