‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা লেগেছিল আগেই। আদালতের নির্দেশে শুধু সেই তকমাই খসে পড়ল না, জালনোট ও বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলা থেকেও মুক্তি পেল হারুণ রশিদ নামের সেই ব্যক্তি। গতকাল ৫ই ফেব্রুয়ারী, সোমবার কলকাতা নগর দায়রা আদালতের দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক কুমকুম সিনহা এই চাঞ্চল্যকর রায় দিয়েছেন। আদালতের মন্তব্য, ধৃতের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা আদালতে কোনওভাবেই প্রমাণিত হয়নি। এদিকে, রায় ঘোষণার পরই হারুণের স্ত্রী রফত সুলতানা কোর্ট চত্বরে দাঁড়িয়ে বললেন, দীর্ঘ সাত বছর আমার স্বামীকে অহেতুক বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এতগুলো বছর কি কেউ আমাদের পরিবারকে ফিরিয়ে দিতে পারবে? সরকারি আইনজীবী গণেশ মাইতি এই রায় নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর সাফ কথা, আমি এ নিয়ে কিছু বলছি না। অন্যদিকে, ধৃতের দুই আইনজীবী নবকুমার ঘোষ এবং ফজলে আহমেদ খান বলেন, এর আগেও পুলিশ আমাদের মক্কেলকে ওয়াটগঞ্জে জালনোটের এক মামলায় ফাঁসিয়েছিল। কিন্তু তারা অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। আর তাই আক্রোশের বশেই তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো কড়া মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১২ সালের ২১ জুলাই কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাক্স ফোর্স (এসটিএফ) ওই ব্যক্তিকে শিয়ালদহ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের দাবি ছিল, তাঁকে জেরা করে সেখানকার একটি হোটেলের ঘর থেকে একটি ব্যাগ পাওয়া যায়। যাতে ছিল নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের নানা পত্র-পত্রিকা ছাড়াও প্রচুর জালনোট এবং একটি টিফিন ক্যারিয়ার ঠাসা বিস্ফোরক পদার্থ। এরপরই ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং বিস্ফোরক আইনে মামলা দায়ের করেন এসটিএফের তৎকালীন ইন্সপেক্টর কৌশিক দাস। এই কেসে তদন্তকারী অফিসার হিসেবে ছিলেন শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশ আদালতে দাবি করে, ধৃত ব্যক্তি এক সময় সিমির পাশাপাশি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পুলিশ মামলার তদন্ত শেষ করে ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর ব্যাঙ্কশাল আদালতে চার্জশিট পেশ করে। কোর্টে সাক্ষ্য দেন মোট ১৬ জন।
এই মামলার শুনানি চলাকালীন বিভিন্ন প্রশ্ন সামনে চলে আসে। ধৃতের আইনজীবীরা বলেন, হোটেলের কয়েকজন সাক্ষী কোর্টে সাক্ষ্য দিতে আসেননি। দ্বিতীয়ত, যে হোটেলে অভিযুক্ত উঠেছিলেন বলে পুলিশ দাবি করেছিল, সেখানকার হাজিরার খাতাতেও নানা অসঙ্গতি রয়েছে। তৃতীয়ত, তিনি যে ঘরে ছিলেন, সেই ঘরের তালা পুলিশ আসল না ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে খুলেছিল, তা নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। চতুর্থত, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা কোর্টে কোনওভাবে প্রমাণ হয়নি। পঞ্চমত, সরকারপক্ষের বক্তব্য ছিল, ধৃতের হেফাজত থেকে জঙ্গি সংগঠনের নানা লিফলেট ও অন্যান্য নথিপত্র পাওয়া গিয়েছে। এর প্রত্যুত্তরে হারুণের আইনজীবীদের বক্তব্য ছিল, কারও হেফাজত থেকে উর্দুতে লেখা কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের কাগজপত্র পাওয়া গেলে তার থেকে প্রমাণিত হয় না যে, তিনি রাষ্ট্রবিরোধী লোক। ষষ্ঠত, এই মামলায় সিজার লিস্ট নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। সব মিলিয়ে এই মামলাকে ঘিরে রয়েছে একগুচ্ছ গাফিলতি। এই সব বিষয়গুলি কোর্টের নজরে আসায় এদিন বিচারক জেল হেফাজতে থাকা অভিযুক্তকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন।