অবশেষে গ্রেপ্তার ভারতের বিন লাদেন। গত ২০শে জানুয়ারী, শনিবার রাতে দিল্লির গাজিপুরে এক রোমহর্ষক গুলির যুদ্ধ এবং চেজিংয়ের পর পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে আব্দুল সুভান কুরেশি। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সবথেকে তুখোড় আর আধুনিকতম প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এই আব্দুল সুভান কুরেশি। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও বটে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কুরেশিকে ভারতীয় গোয়েন্দা আর নিরাপত্তা বাহিনী খুঁজছে ২০০৮ সাল থেকে। তার কোড নেম টেকি টেররিস্ট। এর কারণ আধুনিক টেকনোলজিতে সিদ্ধহস্ত কুরেশি ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনকে প্রযুক্তিগতভাবে একটি নিখুঁত জঙ্গি গোষ্ঠীতে পরিণত করতে সবথেকে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। রিয়াজ আর ইয়াসিন ভাটকলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা, দ্বারভাঙা মডিউলের মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়ানো এবং একের পর এক বিস্ফোরণে অসংখ্য প্রাণহানি। এই ছিল ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন। এমনই এক জঙ্গি সংগঠনকে সাইবার প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করেছে সুভান কুরেশি। তাই তার গ্রেপ্তারি বড় সাফল্য। ২০০৮ সাল থেকে কখনও আমেদাবাদ, কখনও বেঙ্গালুরু, কখনও জয়পুরের সিরিয়াল ব্লাস্টের সঙ্গে যুক্ত কুরেশি। ২০০১ সাল থেকে তার জঙ্গি যোগ।
মুম্বইয়ের বাইকুল্লা এলাকার অ্যান্টনিও ডি’সুজা হাইস্কুলের সম্পূর্ণ চুপচাপ ছাত্র আব্দুল সুভান কুরেশি ১৯৮৮ সালে ৭৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে সেকেন্ডারি পরীক্ষায় পাশ করে। এরপর ভারতীয় বিদ্যাপীঠ থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেকট্রনিক্সে ডিপ্লোমা লাভ করে ভর্তি হয়ে যায় একটি সফটওয়্যার কোর্সে। কোর্সের নাম মাইক্রোসফ্ট সার্টিফায়েড সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার। এভাবে একদিন সে চাকরি পেয়ে যায় ডাটামেট্রিকস সংস্থায় এবং ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। সন্ধান পায় ‘জেহাদ’ নামক একটি বিশ্বজনীন শব্দের। সেই আকর্ষণে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ১৯৯৯ সালে সুদূর মুম্বই থেকে সুভান গিয়ে হাজির হয়েছিল আলিগড়ে। সেখানে আয়োজিত হয়েছিল একটি কনফারেন্স। প্রধান বক্তা প্যালেস্তাইন থেকে আসা হামসা শেখ আহমেদ ইয়াসিন। আলিগড়েই আলাপ সাদিক ইসার আর সেলিম মুজাহিদ ইসলাহির সঙ্গে। যাদের মধ্যে প্রথমজন মুম্বইয়েরই চিতা ক্যাম্পের বাসিন্দা। মুম্বই ফিরেই কুরেশিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সিমির (স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া) দপ্তরে। ২০০১ সালের মধ্যে সে হয়ে পড়ে সিমির মুখপত্র ইসলামিক ভয়েসের অন্যতম কর্মী। শুধু কর্মী হিসেবেই থেকে যায়নি এই তুখোড় ইংরেজি বলিয়ে এবং সাইবার প্রযুক্তি জানা শার্প চেহারার যুবক। সহজেই সে নজরে পড়ে যায় ভাটকল ভাইদের স্লিপার সেলের। তারাই ভাটকলদের খবর দেয় কুরেশির। খোদ রিয়াজ দেখা করে কুরেশির সঙ্গে। কুরেশি ছিল মাস্টার রিক্রুটার। শুধু মুম্বই নয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাকে যেতে হত বিপথগামী মুসলিম যুবকদের জঙ্গি কার্যকলাপে উদ্বুদ্ধ করার জন্য। হাতে ল্যাপটপ, মোবাইল আর পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন। সঙ্গে জ্বালাময়ী বক্তৃতা। তার আকর্ষণে বিপথগামী মুসলিম যুবকরা দাঁড়ায় ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের ছাতার তলায়। এভাবেই প্যান ইন্ডিয়ান নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে কুরেশি। ততদিনে ইয়াসিন আর রিয়াজ চলে গিয়েছে নেপাল হয়ে দুবাই ও তারপর করাচি। সুতরাং ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের ভার কুরেশির উপর। তার বড় সাফল্য ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সঙ্গে বাংলাদেশের হুজির সমন্বয়সাধন। তার প্ল্যানেই হুজি আর ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন যৌথভাবে কাজ করেছে।
২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যেকার বিভিন্ন বিস্ফোরণের পর পুলিশ ও সংবাদমাধ্যমকে ওইসব বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করে ইমেল করার প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। ঠিক যে প্রবণতা ইদানীং দেখা যায় আইএসের মধ্যে। বিশ্বের যেখানেই বিস্ফোরণ কিংবা জঙ্গি হামলা হয়, সর্বাগ্রে আইএস দাবি করে যে ঘটনাটি তারাই ঘটিয়েছে। এর মধ্যে সব দাবি ঠিক নয়। একটি ফিয়ার সাইকোসিস তৈরি করাও এর পিছনে কাজ করে। ২০০৭ থেকে ২০০৮ এর ওইসব ইমেল পর্যালোচনা করে পুলিশ প্রথম কুরেশিকে সন্দেহ করে। সেই থেকে তাকে খোঁজা চলছে। ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করে করে শেষ পর্যন্ত নেপালে ঘাঁটি গেড়েছিল কুরেশি। উল্লেখ্য, ভাটকল এই নেপাল থেকেই গ্রেপ্তার হয়েছিল। এবং দ্বারভাঙা মডিউল হয়ে পড়েছিল বিপর্যস্ত। কুরেশি নেপালের ভোটার কার্ড এবং পাসপোর্ট পর্যন্ত জোগাড় করে ফেলেছিল। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল দুর্বল ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনকে আবার চাঙ্গা করার জন্য। অবশেষে সে প্ল্যান করেছিল উত্তরপ্রদেশের কোনও একটি শহরে আঘাত হেনে ফিরিয়ে আনবে মুজাহিদিনের আতঙ্ক। সেই প্ল্যানের জন্যই সে ভারতে ঢুকেছিল। দিল্লিতে গাজিপুরে সে আছে, এমন খবর পেয়েই শনিবার পুলিশ হানা দেয়। শুরু হয় গুলির লড়াই। পরাস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করে আব্দুল সুভান কুরেশি ওরফে তৌকির। যাকে তার অনুগামীরা ডাকে—ইঞ্জিনিয়ার সাব!